Wednesday 27 April 2016


লেখা
শার্টের বুক পকেট থেকে খানিকটা বেরিয়ে আছে একটা মলিন চিরকূট। লোকটার চোখ উলটোনো, হুশ নেই। সবাই গোল হয়ে দেখছে, আন্দাজ করতে চাইছে, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না। আমি হরিদাস পাইন--আমিও কি আছি ওই ভিরের মধ্যে!! হয়তো আছি। হয়তো নেই। কী যায় আসে? উটকো ঝামেলা কাঁধে নিয়ে দিনটা মিছেমিছি মাটি করার মতো লোক তো আমি নই! অতএব চিন্তা কী?
অথচ লোকটা কিন্তু আমার চেনাই! ধরুন লোকটার নাম চিনিবাস--আমাদের চিনিবাসদা। সে আমার আধা শহর আধা গ্রামের একটি বিপর্যস্ত ছাপাখানার অংশীদার। বিবাহিত কিন্তু সন্তানহীন। স্ত্রী বিয়ের দুমাসের মাথায় কমপোজিটারের সাথে ভেগে গিয়েছে। তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। খোঁজ অবশ্য কেউ নেয়ওনি।
চিনিবাসদা তারপর থেকে শুধু মদ গিলতো দিনরাত। বিধবা মা ভাত নিয়ে বসে থাকতে থাকতে একদিন স্ট্রোক করে মারা যায়। চিনিবাসদা কাঁদেনি। মায়ের পারলৌকিক কর্ম সে করেছিল কিনা সে বিষয়েও কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য কারো কাছে নেই।
রাস্তায় চিৎ হয়ে শুয়ে চিনিবাসদা মারা যাচ্ছে। সবাই গোল হয়ে দেখছে সে দৃশ্য। গাজনের সঙেরা মহাদেব, মা-কালীর মুখোশ পড়ে যখন বড় রাস্তায় নাচতো, আমরা ঠিক এভাবেই গোল হয়ে দেখতাম ছেলেবেলায়। কী আনন্দেরই যে ছিল সেই সব দিনগুলো!
হঠাৎ একজন বললো--মানুষ তো নয়, আস্ত পিঁপে একটা!
পাশ থেকে অন্যজন বললো--বউ কি কারো সাধে ভেগে যায়! সত্যি...
তৃতীয় জন একটু ভদ্দর গোছের; সে বললো--There is a limit brother...somewhere you have to draw the line...
চিনিবাসদার নাভিশ্বাসও এবার ক্রমেই স্তিমিত হয়ে আসছে। মুখ হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছিলো সে এতোক্ষণ। এখন তাও বেশ অনিয়মিত..বোঝা যাচ্ছে হাতে আর সময় খুব নেই। যে কোনো সময় সে ঢলে পড়বে।
এ মুহুর্তে আমার মন পড়ে যাচ্ছে সঞ্জয় লীলা বনসালির 'দেবদাস' ছবিটার কথা। শেষের সেই মৃত্যুদৃশ্য! ওহ! শাহরুখের মৃত্যুতে সেদিন কেঁদে ভাসিয়ছিলাম আমরা প্রায় হলসুদ্ধ সকলেই। মনে পড়লে চোখে জল আসে এখনো।
চিনিবাসদার বুকপকেটের চিরকূট সবটাই প্রায় বেরিয়ে এসেছে দেখছি! আচ্ছা কিছু কি লেখা আছে ওতে! হয়তো আছে। হয়তো নেই। কী যায় আসে!
মরে গেলে চিরকূটটা পড়ে অধিকাংশই তো বার দুই-তিন চুক চুক করেগ জোরে পা চালিয়ে কেটে পড়বে। পাছে সৎকারের চাঁদা দিতে হয়! আমিই বা ব্যতিক্রম কীসে!
ইতিমধ্যে দুজন লাঠিধারী কোথ্থেকে উড়ে এসে হম্বিতম্বি শুরু করে দিয়েছে।
'দূর হটো দূর হটো' বলে লাঠি উঁচিয়ে এই শেষ দৃশ্যে হঠাৎ তাদের প্রবেশ। দূটো পয়সার ধান্ধা হলেও হতে পারে ভেবেছে হয়তো। যা হোক, ক্রমেই বেশ জমে উঠছে কিন্তু ব্যাপারটা!
হঠাৎ মুখবিকৃত হলো চিনিবাসদার। চিনিবাসদা কি কিছু বলতে চায়!
নাক-মুখ দিয়ে তরল গ্যাজলা গ্যাজলা কী যেন বের হয়ে আসছে। তারপরেই, যাঃ-- শ্বাস থেমে গেলো!
চিরকূটটা বেরিয়ে এসেছে সম্পূর্ণ। তবে আঁঠালো গ্যাজলা লেগে ভিজে গেছে একদম। বেশ বোঝা যাচ্ছে হাতের লেখাটি অস্পষ্ট, কম্পিত। কিছুই ঠিক পড়া যাচ্ছে না।

No comments:

Post a Comment